ব্রিটিশ পুঁজিবাদের উত্থান ও দাসব্যবসার সম্পর্ক

জুনের এগারো তারিখ ব্রিস্টলে দাস ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কলস্টনের মূর্তি উপড়িয়ে ফেলার ঘটনা আটলান্টিক দাস ব্যবসার সাথে ব্রিটেনের সংযোগকে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। যদিও দাসব্যবসা১৮০৭ সালে ব্রিটেনে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ হয়েছিল, তবে ব্রিটেনের পুঁজিবাদের উত্থান আর বিশ্বশক্তি হিসেবে ব্রিটেনের আবির্ভাবের মূল খুঁটি হিসেবে কাজ করেছে এই নির্মম ব্যবসা৷

শ্রেণীভিত্তিক সমাজের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়েই দাসপ্রথার অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়৷ তবে বর্তমানকালে দাসপ্রথা দিয়ে মূলত পশ্চিম আফ্রিকা থেকে মানুষ ধরে এনে আমেরিকা আর ক্যারিবিয়ান অঞ্চলেজোরপূর্বক কাজ করানোর ব্যাপারটিই বুঝানো হয়।

পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, পর্তুগাল স্বর্ণের খোঁজে আফ্রিকার উপকূল 'আবিষ্কার' করে৷ পর্তুগাল ছিল প্রথম ইউরোপীয় দেশ, যারা আফ্রিকায় গিয়েছিল। এর ফলে পর্তুগাল দক্ষিণের ইসলামি দেশগুলার নিষেধাজ্ঞাকে এড়িয়ে গিয়ে আফ্রিকায় ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সুবিধাপেয়েছিল৷ এইসময়ে, দাসব্যবসাও শুরু হয়েছিল, তবে স্বল্প পরিমাণে। স্বর্ণই ছিল সবচেয়ে সৌভাগ্যের জিনিস।

যেমন, ১৪৭০ সালে পর্তুগিজরা ‘স্বর্ণ উপকূল’ নামে পরিচিত ঘানায় গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে, আমরা দেখি আফ্রিকা থেকে ইউরোপে স্বর্ণ বাণিজ্য হচ্ছে৷ এইসময়ে, পর্তুগালকে হটানো ছাড়া ব্রিটেনেরআধিপত্য বিস্তার সম্ভব হতো না। যদিও পরবর্তীতে, দাস হিসেবে মানুষের কেনা-বেঁচা আরো লাভজনক ব্যবসা হিসেবে হাজির হয়।

দাসপ্রথার রূপকার

এইসময় ব্রিটেনও দাসব্যবসা শুরু করে৷ দাসব্যবসায় ব্রিটেন যুক্ত হয় ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে৷ খুব দ্রুতই ট্রান্স-আটলান্টিক অঞ্চলে দাসব্যবসার স্থপতি রূপে হাজির হয় ব্রিটেন৷ এর মাধ্যমে, একটি পুঁজিবাদী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটানোর জন্য যে উচ্চমূল্যের মুনাফা দরকার ছিল, সেটা দাসব্যবসার মুনাফার মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল।

যেসব কোম্পানিগুলো দাস ব্যবসায় যুক্ত ছিল, তারাই শিল্প বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল পরবর্তীতে। উদীয়মান পুঁজিবাদী শ্রেণীর জন্য বিশ্ববাণিজ্য বিস্তারে দাসব্যবসাই প্রধাণ ভূমিকা পালন করেছিল। কার্ল মার্ক্সের ভাষায়ঃ

"দাসপ্রথাই কলোনিগুলোকে মূল্যায়িত করে, আর এই কলোনিগুলোর মাধ্যমেই বৈশ্বিক বাণিজ্য শুরু হয়। বৈশ্বিক বাণিজ্য সেসময়কারযন্ত্রনির্ভর ভারী শিল্প-কারখানার জন্য খুব দরকারী ছিল। দাসব্যবসার আগে, পূর্বের জামানায় কলোনিগুলো থেকে খুব কম পণ্যই রপ্তানি হতো,এবং পৃথিবীর চেহারা পাল্টে দেবার ক্ষেত্রেও তখন তেমন কোন পরিবর্তন ঘটায়নি।"

পর্তুগাল আর আমেরিকা ছিল সবচেয়ে 'সফল' দাসব্যবসাকারী দেশ,যারা আমেরিকায় যেসব আফ্রিকানদের পাঠানো হচ্ছিল, তার ৭০% নিয়ন্ত্রণ করতো। যদিও লিভারপুল, ব্রিস্টল, পোর্থসমাউথ, ল্যাঞ্চেস্টারে দাস লেনাদেনার বন্দর ছিল, তবে ব্রিটেনের বেশিরভাগ অঞ্চলে দাসের প্রচলন ছিল না, যার ফলে এই দাসপ্রথার প্রকৃতি সরাসরি দেখতে পায়নি ব্রিটেন।

আমেরিকা যেভাবে তার দাসদের কাজ করিয়ে তাদের অভ্যন্তরীন অর্থনীতি গড়ে তুলছিল,ব্রিটেন তেমনটি করতে পারেনি। তারা জোর দিয়েছিল বাণিজ্যে৷ এইজন্য দাসপ্রথা আর রেসিজমের পক্ষে মতাদর্শিক পক্ষপাতিত্ব আমেরিকায় বেশি, কারণ তারা এটা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে৷

ব্রিটেনের আধিপত্য চুড়ায় উঠেছিল ১৬৪০ থেকে ১৮০৭ সাল পর্যন্ত, যখন ব্রিটেনের দাস ব্যবসা কৌশলে নামমাত্র আনুষ্ঠাকিতা পালনের মধ্যে দিয়ে ‘উচ্ছেদ’ করা হয়েছিল৷ আমেরিকায় যদিও গৃহযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই প্রথা টিকে থাকে৷ শেষ হয় ১৮৬৫ সালে।

অর্থনৈতিক প্রেরণা

ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে এই দাসপ্রথার উচ্ছেদ নিয়ে একটা মিথ্যা বাহাদুরি কাজ করতো। কারণকাগজে-কলমে ব্রিটেনই প্রথম সেটা করেছিল (যদিও বাস্তবে ১৮৩০ এর দশক পর্যন্ত দাসপ্রথা স্থায়ী ছিল ব্রিটেনে)।

যাই হোক, এই উচ্ছেদের পেছনে আসলে কালো মানুষদের দাস বানানো নিয়ে মনোভাব পরিবর্তনের তেমন কোন ভূমিকা নাই। বরং, এটা প্রভাবিত হয়েছিল অর্থনৈতিক মুনাফার ব্যাপার দ্বারা। পুঁজিবাদের উত্থানের সময় ওরা বুঝতে পেরেছিল যে দাসব্যবসার থেকে নামমাত্র ‘স্বাধীন’ মজুরি শ্রমিককে খাটানো বেশি লাভজনক।

এ.এল. মর্টন তার ‘A People's History of England’ বইটিতে উল্লেখ করেন, 'আঠারো শতকে যেমন দাসব্যবসা খুব লাভজনক ছিল, উনিশ শতকে তাদের রক্ত শুষে মজুরি খাটানো ছিল আরো লাভজনক। ' সহজ ভাষায় বলতে গেলে, দাসব্যবসা তখন আর যথেষ্ট লাভজনক ছিল না।

আবার সেইসময়ে দাসপ্রথা উচ্ছেদের জন্য বিভিন্ন আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছিল। এইসব আন্দোলন ব্রিটেনের নিজ দেশে আর কলোনিগুলোতে- দুইজায়গাতেই হচ্ছিল। যেসব আন্দোলন মূলত সংগঠিত হয়েছিল তৎকালীন র‍্যাডিকাল ভাবধারার লোকজনদের দ্বারা।

এছাড়া সেসময় দাসদের বিদ্রোহও ক্রমে বাড়ছিল৷ এরমধ্যে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ হয় ১৮৩১ সালে, জ্যামাইকায়। এটা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।

মার্ক্স লক্ষ্য করেছিলেন যে, শাসক শ্রেণীর জন্য দাস আর আধুনিক যন্ত্রপাতির আবির্ভাব, এই দুইটির মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ছিল। একজন দাস সস্তা হতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে যন্ত্রপাতি চালনা কিংবা উৎপাদন বাড়ানোর জোর নেই। দিনশেষে সে একজন দাসই। এদিকে একজন দিনমজুর সারাদিন খেটে তার মালিকের চাহিদা পূরণ করতে পারে।

মার্ক্স দাসবিদ্রোহের গুরত্ব নিয়েও আলাপ করেছিলেনঃ

"আমার মতে, বর্তমান সময়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে আমেরিকায় দাসদের মধ্যে বিদ্রোহ, যেটা শুরু হয়েছে ব্রাউনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, পাশাপাশি রাশিয়ায় দাসদের বিপ্লব৷ অন্যদিকে... আমার কাছে এটাও গ্রুত্বপূর্ণ যে, মিসৌরিতে একটা নতুন আন্দোলন দানা বেঁধেছিল নিপীড়িতদের মধ্যে, সেটি স্বাভাবিকভাবেই শাসক শ্রেণীর দ্বারা দমিত হয়েছিল, এর দ্বারা বুঝাই যাচ্ছে শাসকশ্রেণীর মতলবটা কী।”

উচ্ছেদের ধোঁকা

দাস প্রথা উচ্ছেদের ফলে স্বাভাবিকভাবেই দাসব্যবসায়ীরা কিছুটা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। তবুও এই ব্যবসা উচ্ছেদের পর দাসমালিকরা মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেয়। যা আজকের দিনের হিসাবে প্রায় ১৭বিলিয়ন ইউরো হবে।

এটা এমন একটা ব্যাপার যেটা নিয়ে শাসক শ্রেণীর লজ্জিত হওয়া উচিত। কিন্তু না, বরং রাজস্ব-বিভাগ তার অফিসিয়াল টুইটার পেজ থেকে ২০১৮ সালে গর্বের সাথে টুইট করে, 'আপনারা লাখ লাখ মানুষ ট্যাক্স দিয়ে দাস ব্যবসা বন্ধ করতে সাহায্য করেছেন।”

এইটা কালো মানুষদের এমন এক বার্তা দেয় যে, তোমাদের কিছু পূর্বপুরুষ দাস ছিল, তাদেরকে মুক্ত করা হয়েছে, এখন দাসদের যারা মালিক ছিল, তাদের ঋণ শোধ করতে হবে কর প্রদানের মাধ্যমে!'

এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়াই একটি বড় ধরনের ধোঁকাবাজি ছিল। শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণ নিয়েই মালিকরা ক্ষান্ত হন নাই, সরকার এমন একটা নিয়ম করেছিল যার ফলে, একজন দাসকে তার থাকাখাওয়ার বন্দোবস্তের জন্য আগের মালিকের অধীনে ৪-৫ বছর কাজ করতে হবে। তাদের বিনামজুরিতে সপ্তাহে ৪৫ ঘন্টা করে খাটতে হতো।

এই উচ্ছেদ আইন ব্রিটেনকে দাসব্যবসা প্রতিরোধে বৈশ্বিকভাবে তদারকের ভূমিকা এনে দেয়৷ ব্রিটেনের নৌবাহিনীর স্কোয়াড্রনগুলো পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলগুলোতে অবৈধ দাসব্যবসা বন্ধ করার জন্য টহল বসাতে থাকে। কিন্তু ব্রিটেনের আসল উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকা দখল করা। যেটা সেইসময়ে ব্রিটিশ পুঁজিবাদের মুনাফার জন্য দরকার ছিল।

অতীত স্মৃতির গুরুত্ব

এই দাসপ্রথার ভূত এখনো আমাদের অসমতার সমাজে টিকে আছে। এটা উচ্ছেদ করা হলেও, শোষণ টিকে আছে এখনো। আর এই অসম ব্যবস্থার মাঝে কালো মানুষদের উপর বৈষম্য দিনদিন বেড়েই চলেছে।

আমরা বিভিন্ন ভাস্কর্যগুলোতে এর ছাপ দেখতে পাই। দাসব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণের জন্য যখন ২০০ বছর পর ২০১৫ সালেও ব্রিটেনের মানুষদের কর শোধ করতে হয়, তখনোই বুঝা যায় এর প্রভাব কিভাবে টিকে আছে। আমরা যখন পরম্পরাভিত্তিক দারিদ্র্য, বাসস্থানসংকট কিংবা কৃষ্ণাঙ্গদের 'ভয়ংকর, 'উগ্র', 'বুদ্ধিহীন' প্রভৃতি প্রবণতা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে দেখি, তখন বুঝা যায় এই ছাপ এখনো রয়ে গেছে।

দাসব্যবসায়ীদের ধারা টিকে আছে আজকের দিনের শাসকদের মধ্যেও। যেমন, ব্রিটেনের একসময়কার প্রধাণমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের পারিবারিক সম্পর্ক আছে দাস ব্যবসায়ীদের সাথে। জেনারেল স্যার জেমস ডুফ ছিলেন একজন আর্মি অফিসার এবং স্কটল্যান্ডের এমপি৷ তিনি ক্যামেরনের বড়চাচার পুত্র ছিলেন। ১৭০০ শতাব্দীর শেষদিকে ২০২ জন দাসের জন্য তাকে ৪,১০১ ইউরো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৩ মিলিয়ন ইউরোর মত।

তবে শুধু ক্যামেরনই না, হাউস অফ লর্ডসের অনেক সদস্য এমনকি খোদ রাণীও এইসব দাসব্যবসায় জড়িত থাকা এবং প্রভাবশালী দাসমালিক পরিবারেরই উত্তরাধিকার।

ব্রিটেনের পুঁজিবাদের এই রমরমা অবস্থা হয়েছিল প্রধাণত কালো মানুষদের দাস বানানোর মাধ্যমেই। মার্ক্স ঠিকই বলিছেলন, এ যেন 'শরীরের প্রতিটি ধমনী থেকে রক্ত চুষে নেওয়া'।

বরিস জনসন আর টরি পার্টির লোকেরা বলেন আমাদের অবশ্যই অতীতের কথা মনে রাখা উচিত। হ্যা, অবশ্যই উচিত। আমাদের উচিত ব্রিটেনের দাসপ্রথা থেকে উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারি পর্যন্ত শাসক শ্রেণীর সকল অপরাধগুলোকে মনে রাখা।

শ্রমিক-মজুররা সবকিছুই মনে রাখে৷ আর ইতিহাস থেকেই আমরা দেখতে পাই যে, অল্প কিছু মানুষ দ্বারা বেশিরভাগ মানুষ শাসিত হওয়ার চেয়ে বর্বর প্রথা আর নাই৷ আমাদের অবশ্যই এই ব্যবস্থা পুরোপুরি উচ্ছেদের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে৷

মূল লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল socialist.net ওয়েবসাইটে।

সংশ্লিষ্ট ভিডিও।